
মানুষ কি মাংসাশী(Carnivore) প্রাণী?
*এই যুগের সর্বভুক প্রাণী- মানুষ
*মানুষের প্রকৃতি নির্ধারিত খাবার
*বাস্তব দৃষ্টান্ত
*শেষ কথা
এই যুগের সর্বভুক প্রাণী- মানুষ
খাদ্যের প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে প্রাণীজগৎকে দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে: মাংসাশী, অর্থাৎ যারা মাংস খেয়ে জীবনধারন করে এবং তৃণভোজী (বা শাকাশী), অর্থাৎ যারা উদ্ভিদজাত খাবার খেয়ে জীবনধারন করে। যেসব প্রাণী একই সাথে প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ খাদ্য খেয়ে জীবনধারন করতে পারে, তাদের সর্বভুক প্রাণী বলে। এরা খাদ্য হিসেবে ছত্রাক, শৈবাল, মস ইত্যাদিও গ্রহণ করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতবাদ অনুযায়ী মাংসাশী থেকে কোন প্রজাতি সরাসরি তৃণভোজীতে বিবর্তিত হতে পারে না। আবার একইভাবে উল্টোটা ঘটাও অসম্ভব।
বিবর্তনের ধারা অনুযায়ী কোন মাংসাশী প্রজাতিকে তৃণভোজী বা তৃণভোজী প্রজাতিকে মাংসাশীতে বিবর্তিত হতে হলে অবশ্যই মাধ্যমিক একটি পথ হয়ে আসতে হবে। এ প্রকল্পটি সর্বভূক প্রাণীদের উদ্ভব সম্পর্কে ধারণা দেয়। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে অনেকগুলোই সর্বভূক প্রাণী। যেমন- মানুষ, শিম্পাঞ্জি, গরিলা, শূকর, ভালুক, কাঠবিড়ালী, নেংটি ইঁদুর, ধাড়ি ইঁদুর ইত্যাদি। বহু প্রজাতির পাখিও সর্বভূক; যেমন- পাতিকাক, ভাতশালিক, গোবরে শালিক, হাড়গিলা, মুরগি ইত্যাদি।
(উইকিপিডিয়া)
আদি মানুষ যত উত্তরে স্থানান্তরিত হয়েছিল, তারা প্রায়শই বেঁচে থাকার জন্য প্রাণীজ দ্রব্য খেয়েছিল কারণ পর্যাপ্ত উদ্ভিদজাত দ্রব্য সহজলভ্য ছিলনা। মাংস উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাদ্যের পরিপূরক হিসাবে খাওয়া শুরু হয়েছিল। প্রায় দুই মিলিয়ন বছর আগে আমাদের বৃহত্তর মস্তিষ্কের বিবর্তনের জন্য মাংস খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নিম্ন-মানের উদ্ভিদ খাদ্যের পরিবর্তে ক্যালোরি-ঘন মাংস এবং মজ্জা সরাসরি আমাদের মস্তিষ্ককে জ্বালানী ও দেহে পর্যাপ্ত শক্তি দিতে শুরু করে। বলতে গেলে তখন থেকেই আমরা সর্বভুক হতে শুরু করি। পোড়া মাংসের বারবিকিউর ঘ্রাণে আমরা আদিমতা অনুভব করি। পুরুষদের এখনও মৌলিক গুহামানব প্রবৃত্তি আছে, ‘মাংস আনো, আগুন ধরাও, মাংস রান্না করো।’
বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের খাদ্যাভ্যাস বোঝায় যে মানুষ সর্বভুক। কিন্তু আমাদের শরীর কি বলে? উত্তরটি আমাদের অতীতে রয়েছে। অতীতে মানুষ তৃণভোজীই ছিল। জানলে অবাক হবেন মানুষ এখন সর্বভূক হলেও এনাটমিক্যালি সে নিরামিষভোজীই রয়ে গেছে। চায়না স্টাডি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক গবেষণা দেখায় যে সম্পূর্ণ শস্য/হোল গ্রেইন, উদ্ভিদ-ভিত্তিক (WFPB) ডায়েট মানুষের জন্য সর্বোত্তম। আমরা মাংসাশী প্রাণী যেমন সিংহ এবং নেকড়েদের থেকে খুব আলাদা – আমাদের ছোট, নরম নখ এবং ছোট, ভোঁতা দাঁত রয়েছে। অন্যদিকে, তাদের শক্তিশালী চোয়াল রয়েছে। ধারালো দাঁত এবং নখর তাদের কাঁচা মাংসের টুকরো ছিঁড়ে ফেলতে এবং কেটে নামাতে সাহায্য করে। তাদের অম্লীয় পাকস্থলী তাদের মাংস দ্রুত হজম করতে সাহায্য করে এবং তাদের ছোট অন্ত্র হজমকৃত মাংসের অবশিষ্টাংশ দ্রুত বের করে দেয়।
(ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডকুমেন্টারিস)
🔴মানুষের প্রকৃতি নির্ধারিত খাবার
তৃণভোজী, মাংসাশী এবং সর্বভূক- খাবারের প্রকৃতিভেদে প্রাণীকূলের সকল জীবকে মোটাদাগে এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। কোন প্রাণী কী খেয়ে বাঁচবে এবং খাবার তার শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডে কী প্রভাব ফেলবে তাও এক প্রকার সুনির্দিষ্ট। বাঘ-সিংহ সারাবছর মাংসই খায়; গরু-ছাগল বা হরিণের অরুচি নেই প্রতিদিন ঘাসপাতা খাওয়ায়। কারণ এগুলোই এদের প্রকৃতি-নির্ধারিত খাবার।
মানুষেরও কি খাবারের কোনো প্রকৃতি-নির্ধারিত ধরণ আছে? এনথ্রোপলজিস্ট বা নৃ-বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন প্রধানত তৃণভোজী। প্রাণিজ আমিষ অর্থাৎ মাছ মাংস ডিম দুধ খেতে পেলেও তা ছিল অনেক কম। এর সপক্ষে তারা দুটো প্রমাণ উপস্থাপন করছেন- এক) পরিপাকতন্ত্রের গঠন, দুই) দাঁতের গঠন। হরিণের কথাই ধরা যাক। হরিণ তৃণভোজী; এর মুখ থেকে মলদ্বার পর্যন্ত পরিপাকতন্ত্রের দৈর্ঘ্য গড়ে ২৮ ফুট। অন্যদিকে, মাংসাশী প্রাণী বাঘের পরিপাকতন্ত্রের গড় দৈর্ঘ্য ৩ থেকে ৭ ফুট। তৃণভোজী হরিণের পরিপাকতন্ত্রের দৈর্ঘ্য বেশি হওয়ার কারণ সবজি পাতা তৃণলতায় প্রচুর আঁশ বা ফাইবার থাকে, যা হজম করার জন্যে প্রয়োজন দীর্ঘ পরিপাকতন্ত্র। বিপরীতে, মাংসে যেহেতু ফাইবার থাকে না তাই বাঘের পরিপাকতন্ত্র এত লম্বা হওয়ার প্রয়োজন নেই।
মানুষের পরিপাকতন্ত্রের দৈর্ঘ্য কত জানেন? গড়ে ৩০ ফুট! অর্থাৎ, হরিণের চেয়েও বেশি। কাজেই মাংসাশী বাঘ-সিংহ নয়, মানুষের খাবার হওয়া উচিৎ তৃণভোজী গরু-ছাগল-হরিণের মতো। শুধু পরিপাকতন্ত্রই না, দাঁতের গঠনেও মানুষের সাথে মিল রয়েছে তৃণভোজী প্রাণীদের। মাংসাশী প্রাণীর সাথে মানুষের মাত্র ৪টি দাঁতের মিল আছে। এগুলোকে বলা হয় ক্যানাইন টুথ। কারণ আমাদের মুখের দু’পাশে উপর-নিচ এই দাঁতগুলো মাংসাশী প্রাণী কুকুরের দাঁতের মতোই চোখা। বাকি ২৮টি দাঁত তৃণভোজী প্রাণী গরু-ছাগলের মতো। অর্থাৎ, প্রকৃতিগতভাবেই আমরা মূলত তৃণভোজী।
প্রকৃতি বলছে সাতদিন শাক-সবজি তরি-তরকারি আর একদিন মাছ-মাংস হওয়া উচিৎ আমাদের খাদ্যাভ্যাস। কিন্তু আমাদের বর্তমান খাদ্যাভ্যাস ঠিক এর উল্টো! বেশিরভাগ মানুষ সাতদিন খায় মাছ মাংস, নামকাওয়াস্তে একদিন হয়ত সবজি। যেদিনওবা আমরা শাকসবজি খাই সেদিনও পাতে থাকে নিদেনপক্ষে ডিম ভাজা! বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. মাইকেল গ্রিগারের বিখ্যাত বই- হাউ নট টু ডাই। এই বইয়ের মূল বিষয়বস্তু হলো- আপনি যদি সুস্থ থাকতে চান তাহলে আপনাকে মূলত হোল ফুড প্লান্ট বেইজড ডায়েট খেতে হবে। মানে উদ্ভিজ্জ খাবার বেশি খেতে হবে। আম, আপেল বা কমলার জুস নয়, বরং পুরো ফলটাই আস্ত খেতে হবে। লাইফ স্টাইল এক্সপার্টরাও এই তথ্যের সাথে একমত হয়েছেন। প্রাণিজ আমিষ পুরোপুরি বর্জন করবেন তা কিন্তু নয়! তবে গরু বা খাসীর বদলে মুরগী বা মাছ বেশি খান। আর সেটাও পরিমিত। সাতদিন শাকসবজির পর একদিন খেতে পারবেন মাংস- স্রেফ খাদ্যবিজ্ঞানীরাই না, বলছে আপনার দাঁতের প্রকৃতি আর পরিপাকতন্ত্রের গঠনও!
(article.quantummethod.org.bd)
🔴বাস্তব দৃষ্টান্ত
১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সারায়েভো যুদ্ধ চলাকালীন সেখানে ব্যাহত হয় মাছ মাংস ডিম দুধের স্বাভাবিক সরবরাহ এবং সেখানকার অধিবাসীরা দীর্ঘসময় এসব প্রাণিজ আমিষ খাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এ-ছাড়া যুদ্ধের কারণে রান্না করা খাবারও তেমন খেতে পায় নি। শুধু ফলফলাদি, সবজি-সালাদ, রুটি ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে ছিল তারা। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল, যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস ছিল, তারা এই রোগগুলো থেকে নিরাময় লাভ করেছে!
পাকিস্তানের উত্তর সীমান্তে হিমালয়ের কোল ঘেঁষে রয়েছে একটি পাহাড়ি জনপদ, যা ‘হুনজা ভ্যালি’ নামে পরিচিত। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এই পাহাড়ি অঞ্চলটি আধুনিক সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন একটি উপত্যকা। এখানকার অধিবাসীরা হুনজা নামে পরিচিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা দীর্ঘজীবনের অধিকারী। সাধারণ পাকিস্তানিদের গড় আয়ু যেখানে ৬৭ বছর, সেখানে আধুনিক যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ও উন্নত চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হুনজা জনগোষ্ঠীর গড় আয়ু ১০০ বছর। কেউ কেউ এমনকি ১২০ বছর পর্যন্ত বাঁচে! তারা নিজেদের উৎপাদিত খাবার খায় আর বরফগলা পানিতে গোসল করে এবং সেই পানিই পান করে। কোনো ধরনের প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার খায় না। সেই সুযোগই তাদের নেই। হুনজাদের খাদ্যতালিকায় থাকে প্রচুর তাজা ফল, কাঁচা সালাদ, কাঁচা সবুজ পাতা এবং পূর্ণ শস্যদানা, বাদাম, এপ্রিকট, বীজ ও বীনস। মাংস থাকে খুবই কম। তাদের দীর্ঘজীবনের নেপথ্যে আরো রয়েছে প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম আর বিশুদ্ধ বাতাসে দম নেয়ার সুযোগ। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস তাদের কাছে অচেনা।
ওপরের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বর্তমানে এত উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ক্যান্সারের পেছনে প্রধান কারণ অতিরিক্ত প্রাণিজ আমিষ ও মানুষের তৈরি খাবার। মানুষের তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাবার- রিফাইন্ড ভেজিটেবল অয়েল, চিনি, সাদা ময়দা, সাদা নুন ইত্যাদি খাওয়ার ফলে বাড়ছে স্থূলতা, ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, করোনারি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিস। খাদ্য যখন প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তখন খাবারের প্রাকৃতিক অবস্থা বদলে যায়। আবার ওভার কুকিং ও রিফাইনিংয়ের ফলেও খাবারের প্রাকৃতিক অবস্থা বদলে যায়। দীর্ঘদিন এই জাতীয় খাবার গ্রহণের ফলে শরীরে বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে একগুচ্ছ রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হয়, যা DLS (Dioxin Like Substance) নামে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে এই DLS জমা হতে হতে একপর্যায়ে তা Advance Glycosylation End Product (AGE) নামের এক ধরনের ছাই বা বর্জ্য পদার্থে রূপান্তরিত হয়। এই AGE নামের বর্জ্য শরীরে নাইট্রিক অক্সাইড তৈরির ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলে। নাইট্রিক অক্সাইড আমাদের শরীরের জন্যে অত্যন্ত দরকারি। এটি ‘মিরাকল মলিক্যুল’ নামে পরিচিত। এই নাইট্রিক অক্সাইড ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, কিডনি রোগ ও ক্যান্সার প্রতিরোধে পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
(‘এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’, ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান)
🔴শেষ কথা
আধুনিক পৃথিবীতে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সভ্যতা ও সাংস্কৃতির চরম উন্নতি হলেও মানুষের শারীরিক সক্ষমতার অবনতি হয়েছে শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের কারণে। আমাদের খাদ্য তালিকায় বর্তমানে রয়েছে অতিরিক্ত মাংস, হরেক রকমের প্রক্রিয়াজাত, পরিশোধিত, সংরক্ষিত, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য এবং নানান ধরনের কেমিক্যাল মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য। আমাদের আধুনিক সভ্যতার চরম বাস্তবতা মানুবজাতি এই রান্না ও প্রসেসড খাবারে অভ্যস্থ। তাই প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ায় মানুষের রোগ, দূবর্লতা, উদ্যামহীনতা, হিংসাপরায়ণতা, অহংকার, বদমেজাজ, মনঃসংযোগের অভাব ইত্যাদি শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি হচ্ছে।
পৃথিবীর তাবত প্রাণীকুলের খাদ্যের শ্রেণী নির্দিষ্ট করা আছে। প্রকৃতির দিকে তাকালে দেখা যায়, সমস্ত পশুপাখী যে যার মত করে তার দেহের জন্য নির্ধারণ করা খাদ্য আহার করে চলেছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ অথবা অন্য কোন কারণে খাদ্যের অভাব হলে বিশেষ করে তৃণভোজী প্রাণীদের বেলায় দেখা যায়, তারা খাদ্যের সন্ধানে দলে দলে মাইগ্রেট করে অর্থাৎ দল বেধে অন্য কোন জায়গায় চলে যায় তবুও বিকল্প কোন খাদ্য তারা গ্রহণ করে না। মানুষের ক্ষেত্রে বাস্তবে দেখা যায়, তৃণভোজী থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষ সর্বভূক প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। মানুষ মাংসাশী প্রাণী নয় কখনোই। মানুষের শারীরিক প্রকৃতি তৃণভোজীদের নিকটতম। এজন্যই অতিরিক্ত মাংস খেলে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়।