মধুর স্বাস্থ্য উপকারিতা; যা সম্পর্কে জানেন না অধিকাংশ মানুষ
মধু পুষ্টি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, এতে ব্যাকটেরিয়ারোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং সুষম খাদ্যের অংশ হিসেবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
মধু একধরনের মিষ্টি তরল জাতীয় পদার্থ যা মৌমাছিরা উদ্ভিদের ফুল থেকে সংগ্রহ করে। এটি অনেক খাবারেই একটি সাধারণ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা বিভিন্ন আকারে পাওয়া যায়।
মধুর বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সুবিধা রয়েছে এবং এটি অনেকগুলি ঘরোয়া চিকিৎসা এবং ওষুধের বিকল্প চিকিৎসায় ভূমিকা পালন করে।
মধুর প্রমাণ ভিত্তিক ৭টি অনন্য স্বাস্থ্য উপকারিতা
১. মধুতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিগুন
এক টেবিল চামচ, বা ২০ গ্রাম মধু রয়েছে
- ক্যালোরি: ৬১
- চর্বি: ০ গ্রাম
- প্রোটিন: ০ গ্রাম
- কার্বোহাইড্রেট: ১৭ গ্রাম
- ফাইবার: ০ গ্রাম
- রিবোফ্লাভিন: ১% (DV)
- তামা: ১% (DV)
মধু মূলত বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক চিনি, এতে কোনো চর্বি নেই এবং শুধুমাত্র প্রোটিন এবং ফাইবার রয়েছে। মধু সাধারণত ভিটামিন এবং খনিজগুলির একটি উল্লেখযোগ্য খাদ্য তালিকাগত উত্স। এবং এটি লক্ষণীয় যে মধু স্বাস্থ্য-উন্নতিকারী উদ্ভিদ যৌগ পলিফেনল এ সমৃদ্ধ।
২. মধু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ
স্বল্প প্রক্রিয়াজাতকৃত মধুতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জৈব সক্রিয় উদ্ভিজ্জ যৌগ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যেমন ফ্ল্যাভোনয়েড এবং ফেনোলিক অ্যাসিড। গাঢ় রঙের মধুতে হালকা রঙের মধুর তুলনায় বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আপনার শরীরের প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন প্রজাতি (ROS) নিরপেক্ষ করতে সাহায্য করে, যা কোষে জমাট বেধে, অকাল বার্ধক্য, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এর কারণ হতে পারে।
মধুর অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা’র জন্য এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দায়ী।
৩. রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাধারন চিনির চেয়ে মধু বেশি উপকারি
ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রনে মধু সাধারণ চিনির তুলনায় কিছুটা বেশি উপকার দিতে পারে।
যদিও মধু অন্যান্য ধরণের চিনির মতোই আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়, তবে এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিপাকীয় সিনড্রোম এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা করতে পারে।
গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন যে মধু অ্যাডিপোনেক্টিনের মাত্রা বাড়াতে পারে, এটি এমন ধরনের একটি হরমোন যা প্রদাহ কমায় এবং রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ উন্নত করে। এমনও প্রমাণ রয়েছে যে প্রতিদিন মধু খাওয়া টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে ব্লাড সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রনে থাকার সম্ভাবনা বেশি।
যদিও মধু ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য পরিশোধিত চিনির চেয়ে মধু কিছুটা ভাল হতে পারে, তবুও এটি পরিমিত মাত্রায় খাওয়া উচিত ।
এটা জানাও গুরুত্বপূর্ণ যে কিছু উৎপাদক চিনির সিরা দিয়ে মধু পাতলা করে। বেশিরভাগ দেশে মধু ভেজাল করা অবৈধ হওয়া সত্বেও এটি একটি ব্যাপক সমস্যা।
খাঁটি মধু পেতে এইখানে ক্লিক করুন
৪. হার্টের স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারে
মধু হৃদরোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করতে পারে। একটি রিভিউ অনুসারে, মধু রক্তচাপ কমাতে, রক্তে চর্বির মাত্রা নিয়ন্ত্রন করতে, হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করতে এবং সুস্থ কোষের মৃত্যু রোধ করতে সাহায্য করতে পারে।
যার মধ্যে ৪০ বছরের বেশি ৪৫০০ জনেরও বেশি মানুষদের নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণমূলক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পরিমিত মাত্রায় মধু গ্রহণ মহিলাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমিয়েছে। আবার একটি ইঁদুর গবেষণায় দেখা গেছে যে মধু হৃদয়কে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
উপরন্তু, কাঁচা মধুতে সাধারণত প্রোপোলিস থাকে, এটি এক ধরনের রেজিন যা মৌমাছিরা রস উৎপাদনকারী গাছ কিংবা অনুরূপ গাছ থেকে উৎপন্ন করে। প্রোপোলিস কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
পরিশেষে, হার্টের স্বাস্থ্যের উপর মধুর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এখনো গবেষণা উপলব্ধ নয়। হার্টের স্বাস্থ্যের উপর মধুর প্রভাব বিস্তারিতভাবে বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
৫. পোড়া এবং ক্ষত নিরাময়ে উপকারিতা
ঐতিহাসিক নজিরে ক্ষত এবং পোড়া নিরাময়ের জন্য ক্ষতের উপর মধুর প্রলেপ দিয়ে চিকিত্সা করার উল্লেখ আছে। যে অভ্যাসটি আজও প্রচলিত।
মধু এবং ক্ষত পরিচর্যার উপর ২৬টি গবেষণার পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে, অস্ত্রোপচারের পরে সংক্রামিত পোড়া এবং ক্ষত স্থানে মধু প্রয়োগ ক্ষত ও পোড়া নিরাময়ে সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে।
তবে, গুরুতর ভাবে পুড়ে গেলে, ঘরোয়া প্রতিকার স্বীকৃত চিকিত্সার বিকল্প হতে পারে না। এমতাবস্তায় আপনার অবিলম্বে স্বীকৃত চিকিত্সক দ্বারা জরুরি চিকিত্সা গ্রহন করা উচিৎ।
গবেষকরা তত্ত্বে জানা যায় যে, মধুর নিরাময় ক্ষমতা তার ব্যাকটেরিয়ারোধী এবং প্রদাহ বিরোধী উপাদান থেকে আসে।
৬. শিশুদের কাশি দমন করতে সাহায্য করতে পারে
শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত শিশুদের জন্য কাশি একটি সাধারণ সমস্যা। এই সংক্রমণগুলিতে মধু সেবন শিশু এবং পিতামাতার ঘুম এবং জীবনযাত্রার মানকে ভালো করতে পারে।
শিশুদের মধ্যে কাশির জন্য মধু প্রয়োগের উপর বেশ কয়েকটি গবেষণার একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে মধু কাশির লক্ষণগুলির জন্য ডিফেনহাইড্রামিনের চেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এটি কাশির সময়কাল কমাতেও সাহায্য করতে পারে ।
অন্য একটি পর্যালোচনা উল্লেখ করেছে যে মধু কাশিতে আক্রান্ত শিশুদের পাশাপাশি তাদের পিতামাতার মধ্যেও ঘুমের মান উন্নত করতে পারে। আরও, এবং কিছু কাশির ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও মধুর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
কিন্ত বোটুলিজমের(botulism) ঝুঁকির কারণে ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের কখনই মধু দেবেন না।
৭.খাদ্যে যোগ করা সহজ
আপনার খাদ্যে মধু যোগ করা খুবই সহজ। মধু যোগ করে আপনার ডায়েটে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৃদ্ধি করলে স্বাস্থ্যে উপকার হবে, আপনি সবক্ষেত্রেই এটিকে চিনির পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারবেন। সাধারণ দই, কফি বা চা মিষ্টি করার চিনির বিকল্প হতে পারে। আপনি এটি রান্না এবং বেকিং এ ব্যবহার করতে পারেন।
কিন্ত মনে রাখবেন যে মধু এক ধরনের চিনি, তাই দীর্ঘ সময় ধরে নিয়মিতভাবে এটি খেলে আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যাবে। প্রচুর পরিমাণে মধু খেলে ওজন বৃদ্ধি, টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
পুরুষদের জন্য মধুর উপকারিতা কি?
২০২১ সালের একটি পর্যালোচনায় মানুষ এবং প্রাণীদের উপর বেশ কয়েকটি গবেষণার বিশ্বস্ত উত্স থেকে পাওয়া গেছে যে মধু পুরুষদের ইরেক্টাইল ডিসফাংশনে সাহায্য করতে পারে। ভাসোডিলেশন প্রভাবের কারণে ইরেকশনের উন্নতি করতে পারে । শুক্রাণু উত্পাদন এবং জীবনকাল উন্নত করতে পারে এবং টেস্টোস্টেরনের মাত্রা পুনরুদ্ধার করতে পারে।
পুরুষদের স্বাস্থ্যের উপর মধু খাওয়ার প্রভাব সম্পূর্নরুপে জানার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
দিনে এক চামচ মধু কি আপনার জন্য ভালো?
এটা নির্ভর করে আপনার নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য ও চাহিদার উপর। পরিমিত সেবন জরুরী।
মধু একধরনের কার্বোহাইড্রেট যার মধ্যে চিনির পরিমান বেশি (গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ)। এতে প্রতি টেবিল চামচে প্রায় ৬০ বা তার বেশি ক্যালোরি রয়েছে এবং এটি গ্লাইসেমিক সূচকে উচ্চ (এটি দ্রুত রক্তে শর্করা বাড়ায়)।
আপনার যদি আপনার রক্তে শর্করা বা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, আপনার ডায়েটে মধু যোগ করা আদর্শ নাও হতে পারে।
দিনে এক চামচ মধু আপনার জন্য কাজ করতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি অন্যান্য সমস্ত শর্করা জাতীয় খাবার সীমিত পরিমানে গ্রহন করেন এবং একটি পুষ্টি-গুন সম্পন্ন খাদ্যভাস অনুসরণ করেন। মধু গ্রহণ আপনার জন্য উপকারী হতে পারে কিনা তা নির্ধারণ করতে একজন স্বাস্থ্যসেবা পেশাদার আপনাকে সাহায্য করতে পারে।
উপসংহার
মধুতে থাকা উপকারী যৌগ যেমন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রোপোলিস অনেকগুলি সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সুবিধা দেয়।
মধু চিনির একটি দুর্দান্ত বিকল্প তবে তা শুধুমাত্র পরিমিত মাত্রায় গ্রহণ করা উচিৎ, কারণ এটিও একধরণের চিনি।
এছাড়াও, জেনে রাখুন যে ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধু খাওয়ানো উচিত নয়, কারণ এতে বোটুলিজমের(botulism) ঝুঁকি বিদ্যমান।
সূত্রঃ হেলথলাইন